পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলই এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দিতে রাজি নয়। অঙ্ক কষেই এই হানাহানি।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে কীসের লড়াই? গ্রাফিক্স: কৈলাস রায়
অনুব্রত মণ্ডলকে কেন এত দোষ দিলাম, ভেবেই মনটা খারাপ লাগছে। তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলা সভাপতির কথাটা এত খারাপও ছিল না, যতটা আমরা ভেবেছিলাম।
উনি তো ঠিকই বলেছিলেন, রাস্তায় ‘উন্নয়ন’ই দাঁড়িয়ে থাকবে। ভেবে দেখুন, পুরো পঞ্চায়েত নির্বাচনটাই আসলে ‘উন্নয়ন’-এর উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পঞ্চায়েত মানেই তো ‘উন্নয়নের মধুভাণ্ড’। এই সব নবান্ন টবান্ন বা হিল্লি দিল্লি আসলে কিস্সু না। উন্নয়নের চাবিকাঠি কিন্তু পঞ্চায়েতের হাতেই।
কোন চাবি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে পঞ্চায়েতের কাছে? টাকা আর ক্ষমতা। প্রধানমন্ত্রীর নামে প্রকল্পের টাকা বা কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের টাকা হোক বা রাজ্য অর্থ কমিশনের বরাদ্দ টাকা— সবই সরাসরি পঞ্চায়েত সমিতি বা গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে চলে যায়। আর সেই টাকার সঙ্গে যা আসে, তা হল— ক্ষমতা।
‘এক্কা দোক্কা’ কলামের অন্যান্য খবর
একটি সাধারণ হিসাব বলছে, এক একটি গ্রাম পঞ্চায়েত ভাল কাজ করলে সরাসরি সেই গ্রামপ্রধানের কাছে প্রায় ১ কোটি টাকা করে বছরে পৌঁছয় বিভিন্ন উন্নয়ন ও অনুদান খাতে।
অন্যদিকে, সরকারের নতুন শৌচাগার তৈরির পরিকল্পনা হোক বা রূপশ্রী বা সমব্যথী-র মতো রাজ্যের প্রকল্পই হোক— সব টাকারই নিয়ন্ত্রণ আদতে পঞ্চায়েত সমিতি বা গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উন্নয়ন’ নির্ভর করছে গ্রামগুলির উপরে তাঁর কতটা আধিপত্য থাকছে, তার উপরেই। তাই তিনি নিজেই একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই আমরা উন্নয়ন করি। পঞ্চায়েতের জন্যই ১০০ দিনের কাজে আমরা প্রথমে। কারও অপপ্রচারে ভুল না বুঝে, নিশ্চিন্তে তৃণমূলকে ভোট দিন।’’
পঞ্চায়েত হাতছাড়া হওয়া মানেই এই উন্নয়নও হাতছাড়া হওয়া। মানেই ক্ষমতা হ্রাস। এই যে কার বাড়ির সামনের রাস্তা পাকা হবে বা মাটির রাস্তা ইটের হবে বা কোথায় মোরাম পড়বে, কে ১০০ দিনের কাজ পাবে, সরকারি টাকায় কার নতুন বাড়ি হবে, কে ‘উন্নয়ন’-এক কাজের বরাত পাবে— সবই তো পঞ্চায়েতের হাতে। সেটা ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতা যদি কারও হাত থেকে চলে যায়, তাহলে তো হাত মাথায় রাখতে হবে।
এইরকম অবস্থায় রাজ্যের শাসক দল তা হলে উন্নয়ন করবে কী করে! কী করে বলবে— আমাদের সরকার এই কাজটি করে দিল। মাটির স্তরে তো মানুষ অত বুঝবেন না, টাকাটা কোথা থেকে এল। তাঁরা দেখবেন, কারা ‘উন্নয়ন’ করে দিল। এখানেই আসল খেল।
এ তো গেল তিনটি স্তরের মধ্যে একদম নীচে গ্রাম পঞ্চায়েত ও ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির কথা। জেলা পরিষদ দখলও খুব জরুরি। কারণ সেখানেই ‘উন্নয়ন’-এর পরিকল্পনা। সেখানেও নিজের এলাকাকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি।
তার থেকে বড় কথা— জেলা পরিষদের জন্য ভোট দেওয়ার ট্রেন্ড বলে দেবে রাজ্য কার দিকে রয়েছে, কার দিকে যাচ্ছে। তৃণমূল, না বিজেপির দিকে।
কারণ গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী যদিও বা চেনা থাকে, জেলার প্রার্থীদের অনেক সময়ই চেনেন না ভোটাররা। ফলে গ্রামে যদিও বা মুখ চেনার ভিত্তিতে ভোট হয়ও, জেলা পরিষদে সাধারণত ভোটাররা অনেকটা বিধানসভা বা লোকসভার ছকে ভোট দেন। প্রার্থীর প্রতীক চিহ্ন দেখে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল দেখে তাই জেলা পরিষদই বলে দেয়, আগামী বিধানসভা বা লোকসভা ভোটের ট্রেন্ড কী হতে চলেছে।
সেখানেই তৃণমূলের ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই, বিজেপির ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বড় হয়ে ওঠার বাসনা আর বাম ও কংগ্রেসের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। কেউ রাস্তায় নেমে সেই যুদ্ধ করছে, কেউ বা আদালতে লড়াই করছে।
সব কিছু উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই। গ্রাম যার, উন্নয়ন তার। উন্নয়ন যার, ক্ষমতা তার। ক্ষমতা যার, সরকার তার। এই চক্রেই চলছে সব। আমরা খামোখা অনুব্রতকে দোষ দিচ্ছি।
অনুব্রত মণ্ডলের কথাটা প্রথমে কেমন যেন ঠেকেছিল। পরে কিন্তু ভেবে মনে হল, এ তো অমোঘ সত্যি কথা বলেছেন বীরভূমের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি। সত্যিই তো চারিদিকে ‘উন্নয়ন’-ই দাঁড়িয়ে রয়েছে। গোটা পঞ্চায়েত নির্বাচনটাই তো উন্নয়নের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এত মারামারি, সন্ত্রাসের অভিযোগ, আইন আদালত সবই তো উন্নয়নের জন্যই। এই সরল সত্যটা কি সবাই বুঝতে পারছে?
Comments
Post a Comment